নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এর মৌলিক কিছু ধারণা

আমরা সবাই জানি পরমাণুর নিউক্লিয়াস মূলত নিউট্রন এবং প্রোটন দ্বারা গঠিত এবং তারা নিউক্লিয়াসের মধ্যে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার ফোর্স দ্বারা আবদ্ধ থাকে । যদি আলাদা আলাদা নিউট্রন এবং প্রোটনকে একত্রিত করে একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরী করা হয় তাহলে তাদের মধ্য থেকে খুবই সামন্য হারের ভর উধাও বা লুপ্ত হয়ে যায় এই মহাবিশ্ব থেকে । এটা সম্ভব হয় এই কারণে, কারণ আমরা জানি ভর হল শক্তি বা এনার্জি একটি রূপ যা E =MC^2 এই সমীকরণের সাথে সম্পর্কিত ।

এখানে E হলো শক্তি বা এনার্জি , M হলো ভর এবং C হলো আলোর গতি । মহাবিশ্ব থেকে লুপ্ত ভরের সেই শক্তিটুকু মূলত রূপান্তরিত হয় ফোটন কণার শক্তিতে । খুব সামান্য পরিমাণ ভর লুপ্ত হলেও তা থেকে পাওয়া নির্গত শক্তির পরিমাণ খুব বেশী হয় । বিভিন্ন ধরণের নিউক্লী এর গঠন বিভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের প্রতি প্রোটন এবং প্রতি নিউট্রন থেকে লুপ্ত ভরের পরিমাণও বিভিন্ন হয় । মনে করি মোট ওজনের ওপর ভিত্তি করে নিউক্লিয়াস গুলোকে আমরা একের পর এক সারিবদ্ধভাবে রেখেছি । সব থেকে হালকা নিউক্লিয়াসটি সর্ববামে এবং সবথেকে ভারী নিউক্লিয়াসটি সর্বডানে রয়েছে । প্রতিটি নিউক্লিয়াসের ওজন নির্ণয় করা হয়েছে তাদের মোট প্রোটন এবং নিউট্রন সংখ্যার যোগফল থেকে । প্রতিটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা থেকে বোঝা যায় যে এটি কোন ধরণের পদার্থ । ধরি , আমরা দেখবো আলাদা নিউট্রন এবং প্রোটন তৈরী করতে নিয়ম অনুযায়ী প্রতি প্রোটন এবং নিউট্রনে কি পরিমাণ ভর হারাতে বা লুপ্ত করতে হবে । আমরা যখন গ্রাফটির বাম থেকে ডানে যাবো সাধারণভাবে প্রতি নিউট্রন এবং প্রোটনে লুপ্ত ভরের পরিমাণ বাম থেকে ডান দিকে বাড়তে থাকবে । কিন্তু গ্রাফে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা যায় এই পদ্ধতিটি বিপরীতমুখী হয়ে যায় ।

আয়রনের পর থেকে যত ভারী বস্তুর দিকে যাওয়া যাবে প্রতি নিউট্রন ও প্রোটনে লুপ্ত ভরের পরিমাণ তত কমতে থাকবে । গ্রাফের বামদিকে কিছু কিছু পদার্থের নিউক্লী যখন একীভূত হয় তখন মহাবিশ্ব থেকে বেশী পরিমাণে ভর লুপ্ত হয় এবং ভরের শক্তিটি ফোটন কণা হিসেবে বিমুক্ত হয় ।কিন্তু গ্রাফের ডানদিকের পদার্থগুলোর জন্য বিপরীত ব্যপারটি ঘটে । যদি পদার্থগুলোর নিউক্লী একীভূত হয় তাহলে মোট ভরের পরিমাণ বাড়বে । এ থেকে বোঝা যায় যে ভারী ধাতুগুলোর নিউক্লীগুলোর ফিউশনের ফলে শক্তি উৎপাদন করার বদলে শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । সাধারণত নিউক্লীগুলো কখনো একত্রিত হয় না কারণ নিউক্লীতে অবস্থিত পজেটিভ চার্জযুক্ত প্রোটনের উপস্থিতির ফলে নিউক্লীগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে । নিউক্লীগুলো একত্রিত হতে পারে যদি নক্ষত্রের মতো তীব্র চাপ এবং তাপমাত্রার মধ্যে নিয়ে পজেটিভলি চার্জড প্রোটনগুলোর বিপরীতমুখী বলকে অতিক্রম করা যায় । নক্ষত্র মূলত আলো উৎপন্ন করে শক্তি নিঃস্বরণের মাধ্যমে হালকা পদার্থগুলোকে একীভূত করে । যাই হোক ভারী পদার্থগুলোর ফিউশনের ফলে শক্তি হ্রাস পায় এবং এটি সাধরণত ঘটে সুপারনোভা এক্সপ্লুসনের মাধ্যমে একটি নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় ।

একটি নক্ষত্রের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র লোহা থেকে হালকা ধাতুগুলো একত্রিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে । হাইড্রোজেন হলো সব থেকে হালকা মৌল এবং এর ফিউশন হয় থার্মোনিউক্লিয়ার উইপনের মাধ্যমে যাকে আমরা হাইড্রোজেন বোমা বলি এবং যেটি হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমার থেকে বেশী শক্তিশালী । হাইড্রোজেন বোমা দুটি নিউক্লিয়ার এক্সপ্লুশন নিয়ে তৈরী হয় । প্রথমিক এক্সপ্লুশন হাইড্রোজেনকে সংকুচিত করে এবং হিলিয়াম উৎপন্ন করে ।
হাইড্রোজেনের একত্রীকরণের ফলে উৎপন্ন হিলিয়াম অধিক পরিমাণ শক্তি নির্গত করে যার ফলে তারও বড় সেকেন্ডারি এক্সপ্লুশন তৈরী হয় । নিউক্লী গুলোর একত্রীকরণ যাকে আমরা নিউক্লিয়ার ফিউশন বলি, তা শুধু সেকেন্ডারি এক্সপ্লুশনে ভূমিকা রাখে ।

 

প্রাইমারী এক্সপ্লোশনটি ঘটে উল্টো কারণে অর্থাৎ যখন নিউক্লিয়াসটি বিভক্ত হয়ে যায় যাকে আমরা বলি নিউক্লিয়ার ফিশন। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমাগুলো মূলত নিউক্লিয়ার ফিশনের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছিলো। আগেই বলা হয়েছে যখন ভারী পদার্থগুলো একত্রিত হয় তখন ভর বৃদ্ধি পায় এবং শক্তি হ্রাস পায়। এথেকে এটিও বোঝা যায় যে, যখন ভারী পদার্থগুলো বিভক্ত হয়, তখন সর্বমোট ভর হ্রাস পায় ফলে শক্তি বিমুক্ত হয়। নিউক্লিয়াস সাধারণত বিভক্ত হয় না কারণ এতে নিউট্রন এবং প্রোটনগুলো শক্তিশালী নিউক্লিয়ার ফোর্স দ্বারা আবদ্ধ থাকে। যাই হোক নিউক্লিয়াস কখনো কখনো বাড়তি নিউট্রন শোষণ বা ধারণ করতে পারে। কিছু কিছু ধরণের ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়ামে সঠিক পরিমানে নিউট্রন এবং প্রোটন সংযুক্ত থাকে। যার ফলে এতে বাড়তি নিউট্রন সংযুক্ত হলে তা নিউক্লিয়াসকে আনস্টেবল করে ফেলে যার ফলে এর মাঝে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এর ফলে সংলগ্ন নিউট্রন উৎপন্ন হয়। যা অন্য ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম দ্বারা শোষিত হয় এবং এর ফলে চেইন রিএকশনের উদ্ভব হয় ও প্রচুর পরিমান শক্তি নির্গত হয়।

নিউক্লিয়ার উইপনগুলো একটি এক্সপ্লোশন তৈরী করার জন্য অনিয়ন্ত্রিত ধরণের একটি চেইন রিএকশনকে ব্যবহার করে যার ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কন্ট্রোল রড যুক্ত করে চেইন রিএকশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কন্ট্রোল রড এমন ধরণের নিউক্লি ধারণ করে যা নিউট্রন শোষণ করে আনস্টেবল হয় না এবং এবং বিভক্ত হয় না। যদিও নিউট্রন শোষণ করে নিউক্লিয়াস আনস্টেবল হয় না তবুও এটি এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয় যাকে বলা হয় এক্সাইটেড এনার্জি স্টেট । একটি নিউক্লিয়াস যখন এক্সাইটেড স্টেটে থাকে সেটি ঠিক একটি এটমে যখন ইলেক্ট্রন এক্সাইটেড স্টেটে থাকে তার মতো। একটি এটমের নিউক্লিয়াস একটি নির্দিষ্ট পরিমান উচ্চতর এনার্জি লেভেলে যেতে পারে এবং প্রতিটি নির্দিষ্ট এটমের জন্য এই এনার্জি লেভেলের মানও ভিন্ন। ইলেক্ট্রন যেমন নিম্ন শক্তিস্তরে গেলে ফোটন নিঃসরণ করে নিউক্লিয়াসও তেমন নিম্ন শক্তিস্তরে গেলে ফোটন নিঃসরণ করে। উভয় ক্ষেত্রেই দুই এনার্জি লেভেলের মধ্যে পার্থক্য এবং উৎপাদিত ফোটনের এনার্জি সমান। নিউক্লিয়াসের ক্ষেত্রে এনার্জি লেভেলের মধ্যে পার্থক্য বেশি এবং উৎপাদিত ফোটনের শক্তিও বেশি। যখন একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে ফোটন উৎপন্ন হয় তখন আমরা একে গামা রে বলি।

একটি নিউক্লিয়াস সবসময় এক্সাইটেড এনার্জি স্টেটে থাকে যখন এতে নিউট্রন যুক্ত হয়। একটি নিউট্রন অনেকগুলো নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষের পর একটির সাথে যুক্ত হতে পারে এবং এই যুক্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা নির্ভর করে সেই পরমাণুর প্রকৃতি এবং নিউট্রনের গতির উপর। নিউট্রন যুক্ত বা শোষিত হওয়ার একটি ভালো উদাহরণ হলো, কিছু পরমাণু অন্য পরমাণু থেকে ভালো নিউট্রন এবসরব করতে পারে । সাধারণত কম গতিসম্পন্ন নিউট্রন বেশি এবসরব হয়। একটি নিউট্রন খুব তাড়াতাড়ি কম গতিসম্পন্ন হবে যখন এটি হাইড্রোজেনের একটি নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ করবে। নিউট্রন যখন হাইড্রোজেন ছাড়া অন্য পদার্থকে আঘাত করে তখন এর আকার তাদের থেকে ছোট থাকে। অনেকটা ছোট বল বড় বলকে আঘাত করার মতো। তখন এটি যে গতিতে আঘাত করেছিল সেই গতিতেই ফিরে যায়। যদি এটি সমান ভরের বলকে আঘাত করতো তবে এর গতি হ্রাস পেতো। নিউট্রন যখন হাইড্রোজেনের সাথে সংঘর্ষ করে তখন এই ঘটনা ঘটে। যদিও একের পর এক সংঘর্ষে নিউট্রনের গতি হ্রাস পায় তবুও এটি কখনো থেমে যায় না। এর প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের ফলেই পদার্থে থার্মাল ভাইব্রেশন হয়।

যদি নিউট্রনটি আগে থেকেই এই ভাইব্রেশন থেকে কম গতিসম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে নিউট্রনের সাথে এদের সংঘর্ষের ফলে নিউট্রনের গতি বাড়বে। উচ্চ-গতিসম্পন্ন নিউট্রনের গতি হ্রাস পাবে তখন যখন নিউট্রনের শক্তি এবং পরমাণুর থার্মাল ভাইব্রেশনের শক্তি সমান হবে এবং সংঘর্ষ করতে করতে একসময় এটি একটি নিউক্লিয়াসে শোষিত হবে। নিউট্রন এবং প্রোটনের সবধরণের কম্বিনেশন একটি স্টেবল নিউক্লিয়াস তৈরী করে না। নিউক্লিয়াস তখনি আনস্টেবল হবে যখন নিউট্রনের সংখ্যা প্রোটনের তুলনায় খুব কম বা খুব বেশি হবে। কিছু নিউক্লিয়াস অন্যদের থেকে বেশি আনস্টেবল ।

নিউক্লিয়াস যত বেশি আনস্টেবল থাকবে এর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এক এক ধরণের আনস্টেবল নিউক্লিয়াস এক এক ভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যখন একটি এটমের নিউক্লিয়াস এভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত বা বিক্ষিপ্ত হয় তখন এরা নতুনভাবে নিউট্রন এবং প্রোটনের কম্বিনেশন তৈরী করে ফলে নতুন ধরণের ফলে নতুন ধরণের নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। নতুন নিউক্লিয়াসটি স্টেবল বা আনস্টেবল হতে পারে। সেটি তার নিউট্রন এবং প্রোটনের কম্বিনেশনের উপর নির্ভর করে। আনস্টেবল হলে এটি স্টেবল হওয়ার আগ পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত হতে থাকবে। স্টেবল আনস্টেবল যাই হোক যখন এরা তৈরী হবে তখন এরা এক্সাইটেড এনার্জি স্টেটে থাকবে। যার ফলে এটি নিম্ন শক্তিস্তরে যাবে এবং ফোটন নিঃসরণ করবে, যাকে আমরা গামা রে বলি। যখন একটি গামা রে পরমাণুর উপর ক্রিয়া করবে তখন চারটি ব্যাপার ঘটতে পারে-
১. কোনো প্রভাব না ফেলেই এটি এটমের ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে।
২. নিম্ন শক্তির গামা রে ইলেক্ট্রন শোষণ করতে পারে যার ফলে এর সমস্ত শক্তি ইলেক্ট্রনে স্থানান্তরিত হবে এবং গামা রে টি বিলুপ্ত হবে।
৩. উচ্চ শক্তির গামা রে কিছু শক্তির ইলেক্ট্রন শোষণ করতে পারে যার ফলে গামা রে এর দিক পরিবর্তিত হবে।
৪. খুবই উচ্চ শক্তি সম্পন্ন গামা রে এর ভেতর দিয়ে গেলে এটি ইলেক্ট্রন পজিট্রন জোড়াতে রূপান্তরিত হতে পারে। এক্ষেত্রে গামা রে বিলুপ্ত হয় এবং দুই ধরণের পদার্থ উৎপন্ন করে । তারা একে অপরের সাথে ইনটেঙ্গেলড বা বিজড়িত থাকে।

মন্তব্য নেই

আপনার মন্তব্য লিখুন

বিভাগ সমূহ
সম্প্রতি প্রকাশিত
পাঠকের মতামত
আর্কাইভ