হাইজেনবার্গের রহস্যময় অনিশ্চয়তা নীতি

কোয়ান্টাম মেকানিক্সে হহাইজেনবার্গের আনসার্টেইনিটি প্রিন্সিপাল বা অনিশ্চয়তা নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা আমাদের বাহ্যিক জগত সম্পর্কে ধারনা কিছুটা বদলে দেয়। যা আমাদের মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়, যার কিছু উত্তর আমাদের জানা আর কিছু অজানা। তো জানা অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আজ আমরা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি সম্পর্কে জানবো।

১৯২৭ সালে ২৬ বছর বয়সী জার্মান পদার্থবিদ উরনার হাইজেনবার্গ এই নীতিটি প্রকাশ করেন। তাই এই নীতিটিকে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বা হাইজেনবার্গস আনসার্টেইনিটি প্রিন্সিপাল বলা হয়। তার এই নীতিটি অনুসারে, আমরা একটি কনার অবস্থান যত নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করতে পারবো এর ভরবেগ ততই অনিশ্চিত হয়ে যাবে, অর্থাৎ এর ভরবেগ ঠিক কত তা বের করা তত বেশী কঠিন হয়ে পড়বে। ঠিক একইভাবে একটি কণার ভরবেগ যত নিশ্চিতভাবে আমরা নির্ণয় করতে পারবো তার অবস্থান নির্ণয় করা তত কঠিন হয়ে যাবে আমাদের পক্ষে (এখানে জেনে রাখা ভালো, ভর এবং বেগের গুণফলকে ভরবেগ বলে)। এবার, একটি কণার অবস্থানের অনিশ্চয়তা এবং ভরবেগের অনিশ্চয়তাকে যদি আমরা গুন করি তাহলে আমরা একটি মান পাবো। হাইজেনবার্গ প্রকাশ করেছেন, যে কোন কণার জন্য এই গুনফলের সর্বনিম্ন একটি মান আছে, যে কোন কণার ক্ষেত্রেই এর থেকে কম মান আমরা পাবো না। কিন্তু এর থেকে বেশী মান আমরা পেতে পারি। সেই মানটি হল h cut/2.

তাহলে হাইজেনবার্গের সূত্রটিকে গানিতিকভাবে লেখা যায়,

  Δ X Δ P ≥ h cut/2

যেখানে,

Δ X= অবস্থানের অনিশ্চয়তা বা পরিবর্তন

Δ P= ভরবেগের অনিশ্চয়তা বা পরিবর্তন

এখানে, h cut এর মান হল h/2 π. আমরা জানি h হল প্লাঙ্কের ধ্রুবক যার মান ৬.৬২৬ x ১০^-৩৪ জুল পার সেকেন্ড। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ক্ষেত্রে এই ধ্রুবকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক জায়গায় এর ব্যবহার রয়েছে। অর্থাৎ হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে আমরা জানতে পারি যে, একটি কণার অবস্থানের পরিবর্তন এবং এর ভরবেগের পরিবর্তনের গুনফলের সর্বনিম্ন মান হবে h cut/ 2 অর্থাৎ তা কখনোই শূন্য হবে না।

 

হাইজেনবার্গের এই অনিশ্চয়তা নীতি থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, অনেক বেশী ভরবেগ সম্পন্ন কণার সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা যেমন কঠিন ঠিক তেমনি একটি কণার অবস্থান যত নির্দিষ্ট করে আমরা নির্ণয় করার চেষ্টা করবো তার ভরবেগ নির্ণয় করা তত বেশী কঠিন হতে থাকবে। অর্থাৎ একটি কণার একটি নির্দিষ্ট সময়ে এর সঠিক অবস্থান এবং সঠিক ভরবেগ নির্ণয় করা শুধু কঠিনই নয় বরং অসম্ভব! ব্যপারটি খুবই বিস্ময়কর! তাই না? কারন এটি আমাদেরকে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চিত করে দেয়!

এবার এই নীতির একটি পরীক্ষা করা যাক। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির প্রমান পাওয়া যায়, একটি লেজার রশ্মির পরীক্ষায়। একটি পরীক্ষাগারে যদি একটি লেজার রশ্মিকে আমরা একটি এক ছিদ্রবিশিষ্ট স্লিটের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করাই যা অপরপাশে রাখা পর্দায় একটি দাগ বা বিন্দু তৈরি করে। এবার যদি আমরা স্লিটটির ছিদ্রের দৈর্ঘ্য ধীরে ধীরে কমাতে থাকি তাহলে কি হবে? ঠিক তাই যা আমরা ভাবছি। বিন্দুটির দৈর্ঘ্যও ছোট হতে থাকবে। স্লিটটির ছিদ্রের দৈর্ঘ্য কমাতে কমাতে এমন একটা পর্যায় আসবে যখন থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করা শুরু করবে বা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি কাজ করা শুরু করবে। ছিদ্রের দৈর্ঘ্য আরও কমাতে থাকলে একসময় দেখা যাবে বিন্দুটি ছোট হতে হতে আবার দুই পাশে প্রশস্ত হয়ে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শুন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিন্দুটির তো আরও ক্ষুদ্র হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু তা না হয়ে বিন্দুটি প্রশস্ত হয়েছে!

এর ব্যাখ্যা দেয়া যায় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে। যখন স্লিটের ছিদ্রের দৈর্ঘ্য আমরা কমাতে থাকবো তার মানে হবে সুত্রের ΔX  এর মান আমরা কমাচ্ছি অর্থাৎ কণার অবস্থান আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ছিদ্রের দৈর্ঘ্য কমতে কমতে একটি সীমায় গিয়ে দেখা যাবে, যদি আমরা ছিদ্রের দৈর্ঘ্য আরও কমাই তাহলে ব্যাপারটি এমন দাঁড়াবে যে আমরা অনিশ্চয়তা নীতির Δ X Δ P ≥ h cut/2 সম্পর্কটি ভাঙতে যাচ্ছি। অনিশ্চয়তা নীতি বজায় রাখতে এখন যেটি দরকার তা হলো Δ P এর অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাওয়া। ঠিক সে কারনেই আমরা দেখতে পাই যে, X ডাইরেকশনে অনুভুমিক দিকে ভরবেগের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই স্লিটের ছিদ্রের দৈর্ঘ্য আরও কমাতে থাকলে অপরপাশে আপতিত ফোটনের ভরবেগের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেয়ে আরও প্রশস্ত রেখা তৈরি করে। ছিদ্রের দৈর্ঘ্য যত কমানো হবে আপতিত রেখা তত বেশী প্রশস্ত হবে, অর্থাৎ হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিকে প্রমান করবে।

 

আশা করি উপরের আলোচনা থেকে আমরা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেয়েছি, যা আমাদের পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য কিছু বিষয় সম্পর্কে বুঝতেও সাহায্য করবে।

মন্তব্য নেই

আপনার মন্তব্য লিখুন

বিভাগ সমূহ
সম্প্রতি প্রকাশিত
পাঠকের মতামত
আর্কাইভ