আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি এবং সময় সম্পর্কে কিছু ধারণা

আজকে আমরা আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো। আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি মূলত দুইটি নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি।

প্রথম নীতিটিকে আমরা এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি, ধরি আমার কাছে দুটো বস্তু আছে এবং এবং মহাবিশ্বে আর কোথাও কিছুই নেই। তাহলে দুটো বস্তুর মাঝে কোনটি গতিশীল এবং কোনটি স্থির তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। দুটি বস্তুর একটি যদি গ্রহ হয়, সে ক্ষেত্রেও এই নীতিটি প্রযোজ্য হবে।

ধরি কামাল নামের এক ব্যক্তি একটি স্পেসশিপে অবস্থান করছে এবং জামাল নামের এক ব্যক্তি গ্রহে অবস্থান করছে। নভোযানে অবস্থানকারী কামালের সাপেক্ষে নভোযানটি স্থির আছে, বরং গ্রহটি গতিশীল। নভোযানে অবস্থান করে কামাল এমন কোন পরীক্ষা করতে পারবে না যার মাধ্যমে সে জানতে পারবে যে, নভোযানটি গতিশীল এবং সাথে সাথে সে নিজেও গতিশীল।উদাহরণস্বরূপ, সে যদি নভোযানের ভেতর একটি বল উপরে নিক্ষেপ করে সেটি আবার সোজা ভাবে তার হাতে ফিরে আসবে, যেন সে স্থির দাড়িয়ে আছে। গ্রহে অবস্থানকারী জামালের সাপেক্ষে, বলটি নভোযানের সাথে সাথেই গতিশীল এবং এটি এর সম্মুখ ভরবেগ নিয়ে উপরে নিচে উঠানামা করছে। তাই জামাল দেখছে যে, কামালের দৃষ্টিতে বলটি শুধু উপর নিচে উঠানামা করছে। কামালের দৃষ্টিতে নভোযানটি স্থির রয়েছে বরং গ্রহটি গতিশীল ঠিক তেমনি জামালের দৃষ্টিতে গ্রহটি স্থির বরং নভোযানটি গতিশীল।

গ্রহ এবং নভোযানের বাইরে থেকে যদি তৃতীয় কোন ব্যক্তি এই দৃশ্যটি দেখে তাহলে সে দেখতে পাবে যে, গ্রহ এবং নভোযান সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অর্থাৎ দুটোই গতিশীল শুধুমাত্র সূর্যটি স্থির। এবার নভোযান, গ্রহ এবং সৌরজগতের বাইরে যদি কেও অবস্থান করেন তবে তিনি কি দেখবেন ? তিনি দেখবেন সূর্য সেই গ্রহ এবং নভোযানকে নিয়ে বিশাল ছায়াপথকে কেন্দ্র করে ঘুরছে! মূলত, যে কোন পর্যবেক্ষক এটা বিশ্বাস করবে যে, সে স্থির আছে এবং তার চারপাশের মহাবিশ্ব গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, তারা প্রত্যেকেই সঠিক। এটা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না যে সত্যিকার অর্থে কোন বস্তুটি গতিশীল। কারন কোন বল প্রয়োগ করা না হলে অনন্তকাল ধরে সব বস্তুই একই গতিতে একই দিকে গতিশীল থাকবে। পৃথিবীতে বস্তুর গতি হ্রাস পায় বাতাসের ঘর্ষণ এবং বাধাদানের ফলে।

আমরা আগেই জেনেছি আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। তাহলে উপরের ব্যাখ্যা থেকে প্রথম নীতিটিকে আমরা এভাবে লিখতে পারি যে, এটা নির্ণয় করা সম্ভব নয় যে কোন বস্তুটি গতিশীল এবং কোন বস্তুটি স্থির। প্রত্যেক পর্যবেক্ষক যারা ভাবছে তারা নিজেরা স্থির এবং বাকি পুরো মহাবিশ্ব গতিশীল, তারা প্রত্যেকেই সঠিক। আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটির দ্বিতীয় নীতিটির ব্যক্ষা এভাবে দেয়া যায়, আলোর গতি প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের জন্যই এক। ধরি, কামাল নভোযান থেকে একটি লেজার রশ্মি গ্রহের উপর ফেললো। যা একটি আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার নভোযানে ফিরে আসে। লেজার রশ্মির নভোযান থেকে গিয়ে আয়ানায় প্রতিফলিত হয়ে আবার নভোযানে ফিরে আসতে যে পরিমান সময় লাগে ধরি কামাল তা পরিমাপ করলো। কামালের দৃষ্টিকোণ থেকে লেজার রশ্মিটি সোজা গিয়ে আবার সোজা ফিরে আসছে। গ্রহে অবস্থানকারী জামালের দৃষ্টিকোণ থেকে লেজার রশ্মিটি V আকৃতির পথ অতিক্রম করছে। V আকৃতির পথটি সোজা উপর নীচ পথ থেকে বেশি দৈর্ঘ্য সম্পন্ন। যেহেতু আলোর গতি প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের জন্যই সমান কিন্তু জামালের দৃষ্টিতে V আকৃতির পথ অতিক্রম করতে আলোক রশ্মির বেশী সময় লেগেছে। জামাল যদি কামালের ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করে সে দেখতে পাবে কামালের ঘড়ি তার ঘড়ি থেকে ধীর গতিতে চলছে। নভোযান আলোর গতির যত কাছাকাছি গতিতে চলতে থাকবে নভোযানের ভেতরে সময় তত ধীর গতিতে চলতে থাকবে। নভোযানের গতি যদি আলোর গতির সমান হয়ে যায় তাহলে কি হবে? নভোযানের ভেতরে সময়ের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে! বেপারটি খুবই বিস্ময়কর! তাই না? যত দ্রুতই নভোযান চলুক না কেন কামাল কখনোই জানতে পারবে না যে, সময় তার জন্য ধীর হয়ে যাচ্ছে! তার চিন্তা শক্তি সহ সবকিছুই ধীর হয়ে যাবে! তাই ধীরগতির সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা সহ সবকিছুই তার কাছে স্বাভাবিক আগের মতোই মনে হবে। কামালের দৃষ্টিতে এখনো তার নভোযান স্থির আছে এবং বাকি মহাবিশ্ব গতিশীল অবস্থায় আছে। তাই কামালের কাছে মনে হবে বাইরের সবার ঘড়ি ধীর গতিতে চলছে।

ধরি তিনটি সমান দূরত্বের নভোযান সমান গতিতে চলছে। মাঝখানেরটিতে কামাল রয়েছে। ধরা যাক, সে তার নভোযান থেকে বাকি দুটো নভোযানে লেজার রশ্মি ক্ষেপণ করলো। কামালের দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনটি নভোযানই স্থির রয়েছে এবং লেজার রশ্মি বাকি দুটো নভোযানে সমান সময়ে পৌঁছাবে। জামালের দৃষ্টিতে ব্যাপারটি ভিন্নভাবে দেখা যাবে। জামাল দেখতে পাবে, মাঝের নভোযানটি থেকে সমান গতিতে লেজারত রশ্মি বের হয়েছে ঠিকই কিন্তু জামাল দেখবে যদি নভোযানগুলো ডানদিকে ধাবমান থাকে তবে বামদিকের নভোযানটিতে আগে লেজার রশ্মি পৌঁছাবে। কিন্তু আমরা জানি, দুটো নভোযানেই যখন লেজার রশ্মি পৌছাচ্ছিলো তখন তারা একই সময় অতিক্রম করছিলো। তার মানে, গ্রহ থেকে জামালের দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছিলো, বামদিকের নভোযানটির ঘড়ি ডানদিকের নভোযানটির ঘড়ি থেকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত চলছিলো । কামালের দৃষ্টিতে উভয় নভোযানের সময়ই সমান। ধরি কামাল উভয় নভোযানেই নির্দেশ দিলো একই সময় তাদের ইঞ্জিন চালু করতে। কামাল দেখল, তিনটি নভোযানেরই সমান সময়ে ত্বরণ হচ্ছে এবং তাদের মধ্যকার দূরত্ব একই থাকছে। এদিকে, জামাল দেখতে পাবে, বামের নভোযানটির সবার আগে ত্বরণ হচ্ছে তারপর মাঝেরটির এবং সবশেষে সর্বডানেরটির ত্বরণ হচ্ছে এর ফলে তাদের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস পেয়েছে। ঠিক এ কারনেই যে কোন নভোযান যখন অতি দ্রুত চলবে তার আয়তন ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে।  এর বেগ যত আলোর বেগের কাছাকাছি আসবে তত এর আয়তন কমতে থাকবে। যত দ্রুতই নভোযানটি চলুক কামাল কখনোই বুঝতে পারবেনা যে তার নভোযানটি ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে। কারন নভোযানের ভেতরের প্রত্যেক বস্তুই ঠিক সমান পরিমানে ছোট হচ্ছে এমনকি কামাল নিজেও। কামালের প্রেক্ষাপটে এখনো সে এবং তার নভোযান স্থির আছে এবং বাকি মহাবিশ্ব গতিশীল অবস্থায় আছে।

তাই তার কাছে মনে হবে, মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে। কামাল যদি নভোযান নিয়ে ঠিক আলোর গতিতে চলে তাহলে জামালের দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হবে, নভোযানের ভেতরে সময় স্থির হয়ে গেছে। জামালের কাছে মনে হবে, কামালের ঘড়িতে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর পুরো মহাবিশ্ব ঘুরে আসা যাবে। কামালের কাছে তার ঘড়ি স্বাভাবিক সময় দেখাচ্ছে বলে মনে হবে। তাই কামালের কাছে পুরো মহাবিশ্বের দৈর্ঘ্য ছোট হতে হতে একসময় শূন্য হয়ে যাবে।
ধরি, দুটো নভোযান থেকে বল নিক্ষেপ করা হলো, তারা পরস্পর সংঘর্ষ করলো এবং যার যার নভোযানে ফিরে গেলো। ধরি উপরেরটিতে কামাল এবং নিচেরটিতে জামাল রয়েছে। জামালের দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হবে, কামালের ঘড়ি ধীর গতিতে চলছে এবং তার নভোযান, নিক্ষেপিত বল সবই ধীর গতিতে চলছে এবং তাদের ভর বেশী মনে হবে।

এর থেকে আমরা E= mc2 সুত্রের অর্থ বের করতে পারি। অর্থাৎ একটি বস্তু যখন বেশী শক্তি নিয়ে চলবে তখন এর ভর বৃদ্ধি পাবে। যেখানে,
E = শক্তি
m = ভর
c = আলোর বেগ
ঠিক এ কারনেই কোনকিছুই আলোর থেকে দ্রুত বেগে চলতে পারে না। কোন বস্তুর গতি যখন আলোর গতির সমান হয় তখন এর ভর এত বৃদ্ধি পায় যে, এর গতি বৃদ্ধি করতে অসীম শক্তির প্রয়োজন হয়। সে কারনে আমরা শুধুমাত্র কামালের অপরিবর্তিত গতির নভোযানের কথা আলোচনা করছি।

যদি নভোযানটির গতির পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ব্যাপারটি ভিন্ন রকম হবে। ত্বরণের ফলে নভোযানের ভেতর কামাল তার জায়গা থেকে পেছনে সরে যাবে। কামালের দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো নভোযানটি স্থির রয়েছে এবং মহাবিশ্ব গতিশীল অবস্থায় রয়েছে এবং এর ত্বরণ হচ্ছে। নভোযানের ভেতরে তার স্থান পেছনে সরে যাওয়ার জন্য সে মনে করবে, সেখানে নিশ্চয়ই কোন মহাকর্ষীয় বল আছে যা তাকে আকর্ষণ করছে। কামালের দৃষ্টিতে পুরো মহাবিশ্ব এমনকি আলোক রশ্মিও এই মহাকর্ষ শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। যদিও আলোর গতি সব পর্যবেক্ষকের জন্য সমান তবুও এটি মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা আকর্ষিত হয়। তার মানে মহাকর্ষ শক্তি সময়ের প্রবাহকেও প্রভাবিত করে। আমরা আগেই জেনেছি, কামাল যখন আলোর গতিতে নভোযান নিয়ে ভ্রমন করবে তখন নভোযানের ভেতর সময় খুব ধীরে চলবে কিন্তু সে তা বুঝতে পারবে না, তার কাছে সব আগের মতোই স্বাভাবিক লাগবে। তাই সে যখন কয়েক মিনিটের ভেতর ঘুরে আসবে গ্রহে অবস্থানরত জামালের কাছে তখন অনেক বছর পার হয়ে গেছে। কামালের কাছে তখনও মনে হবে সে স্থির এবং নভোযানের বাইরে গ্রহে সময় ধীরে অতিবাহিত হচ্ছে। কামালের মনে হবে মহাকর্ষীয় শক্তির জন্য তার দিকে পৃথিবীর ত্বরণ হচ্ছে। সে ভাববে এই মহাকর্ষীয় বলের জন্যই গ্রহে সময় দ্রুত অতিবাহিত হচ্ছে। সে জন্য কামাল দেখবে তার থেকে জামালের অনেক সময় পার হয়ে গেছে, সে বৃদ্ধ হয়ে গেছে। মূলত মহাকর্ষ কোন শক্তি নয় বরং এটি মহাশূন্য এবং সময়ের সম্মিলিত বক্রতা। ভর বিশিষ্ট বস্তুগুলো মহাশূন্য এবং সময়ের মধ্যে একটি বক্রতা তৈরি করে।

কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে এই বক্রতা অসীম হয়ে যায়। যাকে আলোও অতিক্রম করতে পারে না। তাই কৃষ্ণগহ্বরের কাছে সময় পুরোপুরি স্থির হয়ে যায়। কৃষ্ণগহ্বরের বিপরীত হলো শ্বেতগহব্বর বা হোয়াইট হোল। আমরা অনেক কৃষ্ণগহ্বরের কথা জানি কিন্তু আমরা শুধুমাত্র একটি শ্বেতগহ্বরের কথা জানি। সেই শ্বেতগহ্বরটি হল বিগ ব্যং, যার থেকে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের সৃষ্টি।

সুত্রঃ Eugene khutoryansky

মন্তব্য নেই

আপনার মন্তব্য লিখুন

বিভাগ সমূহ
সম্প্রতি প্রকাশিত
পাঠকের মতামত
আর্কাইভ