পদার্থবিজ্ঞানের কিছু অমীমাংসিত রহস্য পর্ব-২

গত পর্বের পর আজ আবার আমরা পদার্থবিজ্ঞানের আরও কিছু অমীমাংসিত সত্য জানার চেষ্টা করবো, যা হয়তো আমাদের অনেককিছুই আবার নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে।  

১)মহাবিশ্বের ভাগ্য কি?

মহাবিশ্বের ভাগ্য একটি অজানা মানের গুণকের উপর দৃঢ়ভাবে নির্ভর করছে, Ω, যা মহাজগৎ জুড়ে বস্তুর ঘনত্ব এবং শক্তির একটি পরিমাপ। যদি Ω(ওহম) এর মান ১ এর থেকে বেশী হয়, তাহলে স্পেস-টাইম একটি বিশাল গোলকের পৃষ্ঠতলের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। যদি সেখানে কোন ডার্ক এনার্জি না থাকে তবে সে ধরণের মহাবিশ্ব অবশেষে প্রসারিত হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং তার পরিবর্তে সঙ্কুচিত হতে থাকবে, অবশেষে, বিগ ব্যাং এর মতো একটি ঘটনার মাধ্যমে নিজেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে ধ্বসে পরবে। যদি মহাবিশ্ব বন্ধ বা নিরূদ্ধ থাকে এবং সেখানে কোন ডার্ক এনার্জি না থাকে তবে সেধরনের গোলাকার মহাবিশ্ব আজীবন প্রসারিত হতে থাকবে।

অন্যদিকে, যদি Ω ১ এর থেকে ছোট হয় তবে, মহাবিশ্বের আকৃতি একটি গদির পৃষ্ঠতলের মতো খোলা থাকবে। এই ক্ষেত্রে মহাবিশ্বের ভাগ্য হবে, বিশালভাবে স্থবির হয়ে থাকা যা বড় ধরণের ফাটলের দিকে অগ্রসর হবে। প্রথমে, মহাবিশ্বের বাহ্যিক ত্বরণের জন্য সবকিছুকে স্থবির এবং একা করে ছায়াপথ এবং নক্ষত্রগুলো আলাদা হয়ে যাবে। পরবর্তীতে, ত্বরণ এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে এটি পরমাণুকে একত্রিত করে রাখে এমন শক্তির প্রভাবকে কাটিয়ে উঠবে এবং সবকিছুই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

যদি Ω = ১ হয় তবে, মহাবিশ্ব সমতল হবে, সমস্ত দিকে একটি অসীম সমতলের মত এটি প্রসারিত হবে।যদি সেখানে কোন ডার্ক এনার্জি না থাকে তবে এই ধরনের সমতল মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হবে কিন্তু ক্রমাগত এর গতি হ্রাস পেতে থাকবে, নিশ্চলতার কাছাকাছি চলে আসবে। যদি সেখানে ডার্ক এনার্জি থাকে তবে, সমতল মহাবিশ্ব এমনভাবে প্রসারিত হতে থাকবে যে এটি একসময় বড় ধরণের ফাটল তৈরির দিকে ধাবিত হবে।

যাই হোক না কেন, এটি আসলে কিভাবে চলছে? মহাবিশ্ব মরে যাচ্ছে, ২015 সালের ডিসেম্বরে গবেষণায় জ্যোতির্বিজ্ঞানী পল স্টার এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, তার একটি প্রবন্ধে।

২) কিভাবে পরিমাপ, কোয়ান্টাম ওয়েভফাংশনকে অকৃতকার্য করে দেয়?

ইলেক্ট্রন, ফোটন এবং অন্যান্য মৌলিক কণার অদ্ভুত অঞ্চলে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স তত্ত্ব খাটে। কণাগুলি ক্ষুদ্র বলের মতো আচরণ করে না, বরং তরঙ্গের মত বিস্তৃত এলাকায় বিস্তৃত থাকে। প্রতিটি কণা একটি “ওয়েভফাংশন” বা “প্রবাবিলিটি ডিস্ট্রিবিউশন” দ্বারা বর্ণনা করা হয়। যা তার অবস্থান, বেগ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি সম্ভবত কেমন হতে পারে তা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু বৈশিষ্ট্যগুলো কি? তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে এদের মধ্যে কোন পরিমাপ করা হয় না কণাগুলোর সমস্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য এর মানগুলির একটি পরিসীমা থাকে। যখনি একে পরিমাপ করা হয় এর তরঙ্গ ধর্ম ভেঙ্গে পরে। উদাহরণস্বরূপ,কোন কণার অবস্থান নির্ণয় করতে গেলে, কোন পর্যায়ে এসে এর তরঙ্গধর্ম ভেঙ্গে পরে এবং এটি শুধুমাত্র একটি অবস্থান গ্রহণ করে।

কিন্তু কোন কণাকে পরিমাপ করলে কেন তার তরঙ্গ ধর্ম ভেঙ্গে যায়? এটি একটি কঠোর সত্য উপস্থাপন করে যার অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারি। এই সমস্যাটিকে পরিমাপজনিত সমস্যা বলা হয়। কিন্তু কেন এমনটি হয়? যার উত্তর আমরা এখনও জানি না।

৩) স্ট্রিং তত্ত্ব কি সত্যি?

যদি পদার্থবিদরা মনে করেন যে সমস্ত প্রাথমিক কণা প্রকৃতপক্ষে “এক মাত্রিক লুপ” অথবা “স্ট্রিং”, যার প্রতিটি একটি ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পন করে, তবে পদার্থবিদ্যা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। স্ট্রিং এর তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানীদের “কোয়ান্টাম মেকানিক্স” নামে কণার নিয়ন্ত্রণকারী তত্ত্বকে স্পেস-টাইম নিয়ন্ত্রণকারী তত্ত্ব, “জেনারেল রিলেটিভিটি” বা “আপেক্ষিকতত্ত্বের” সাথে সমন্বয় করার অনুমতি দেয় একইসাথে প্রকৃতির চারটি মৌলিক শক্তিকে একক কাঠামোর মধ্যে একত্রিত করে। কিন্তু সমস্যা হল, স্ট্রিং তত্ত্ব শুধুমাত্র ১০ বা ১১ মাত্রাবিশিষ্ট মহাবিশ্বের মধ্যে কাজ করতে পারে, যার তিনটি স্থান সংক্রান্ত, ছয় সাতটি সন্নিবেশিত এবং একটি সময়ের মাত্রা। সন্নিবেশিত এবং স্থান সংক্রান্ত মাত্রাগুলো, সেইসাথে কম্পমান স্ট্রিং, একটি এটমিক নিউক্লিয়াস এর আকারের কোটি কোটি গুন বড়। এত ছোট কোনকিছুকে অনুমান করে সনাক্ত করবার কোন উপায় নেই। তাই স্ট্রিং তত্ত্ব সঠিক নাকি ভুল তা নির্ণয় করারও কোন উপায় নেই।

৪) বিশৃঙ্খলতার কি কোন ক্রম রয়েছে?

পদার্থবিজ্ঞানীরা এখনও এসব সমীকরণগুলোর সঠিকভাবে সমাধান করতে পারেননি যা, জল, বায়ু এবং অন্যান্য তরলের ধর্মগুলোর সঠিক বিশ্লেষিত বিবরণ দিতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে, তথাকথিত ন্যাভিয়ার-স্টোক সমীকরণের সাধারণ সমাধান রয়েছে কিনা তাও জানা যায় না, অথবা সমাধান থাকলেও, এটি সর্বত্র তরলগুলিকে বর্ণনা করে কিনা, অথবা সহজাতরূপে অজ্ঞাত বিন্দুগুলোকে (যাকে “সিঙ্গুলারিটিস” বা “ব্যতিক্রমী-বিন্দু” বলা হয়) ধারণ করে কিনা তাও জানা যায় না। ফলস্বরূপ, বিশৃঙ্খলার প্রকৃতি বা ‘nature of chaos’ ভালভাবে বোঝা যায় না। পদার্থবিজ্ঞানীরা এবং গণিতবিদগণ অবাক হন, ভবিষ্যৎ আবহাওয়া নিয়ে ভবিষ্যৎ বানী করা কি কঠিন নাকি সহজাত রূপেই অনিশ্চিত? নাকি বিশৃঙ্খলতা গাণিতিক যুক্তিকে অতিক্রম করে যায়? নাকি সঠিক গণিতের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব?

৫) মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি কি একত্রিত করা সম্ভব?

মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক শক্তি রয়েছে: ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম, শক্তিশালী পরমাণু শক্তি, দুর্বল মিথস্ক্রিয়া (দুর্বল পারমাণবিক শক্তি হিসাবে পরিচিত) এবং মাধ্যাকর্ষণ। আজ পর্যন্ত, পদার্থবিজ্ঞানীরা জানেন যে, যদি যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিকে সক্রিয় করা যায় তবে উদাহরণস্বরূপ, অ্যাক্সিলারেটরের ভিতরে একটি কণা রাখলে, এই শক্তিগুলোর তিনটি একত্রিত হয়ে একটি শক্তিতে পরিণত হবে। পদার্থবিদরা পারটিক্যাল অ্যাক্সিলারেটরে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বল এবং দুর্বল মিথস্ক্রিয়া বলকে একত্রিত করেন। উচ্চ শক্তিতে একই ব্যাপার ঘটার কথা শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তি এবং মধ্যাকর্ষণ এর সাথে।

যদিও তত্ত্ব তাই বলে, কিন্তু প্রকৃতি সবসময় তা মেনে চলে না। আজ পর্যন্ত কোন পারটিক্যাল এক্সিলারেটর এত শক্তি অর্জন করতে পারেনি যার ফলে এটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম এবং দুর্বল মিথস্ক্রিয়া বলের সঙ্গে শক্তিশালী শক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারে। এখানে মধ্যাকর্ষণকে সংযুক্ত করা মানে হবে আরও বড় শক্তি সংযুক্ত করা। বিজ্ঞানীরা এমন শক্তিশালী পারটিক্যাল এক্সিলারেটর তৈরি করতে পারবেন কিনা তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

মন্তব্য নেই

আপনার মন্তব্য লিখুন

বিভাগ সমূহ
সম্প্রতি প্রকাশিত
পাঠকের মতামত
আর্কাইভ